রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কামরুল হাসান শায়ক নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান

অনলাইন ডেস্ক | আপডেট: বুধবার, ফেব্রুয়ারী ২১, ২০২৪

কামরুল হাসান শায়ক নিজেই  একটি প্রতিষ্ঠান
আবু হেনা মুক্তিঃ
কামরুল হাসান শায়ক। একটি নাম একটি প্রতিষ্ঠান। আমার কাছে তিনি সর্বপ্রথম কবি তারপর লেখক সাংবাদিক ইত্যাদি ইত্যাদি। পুস্তক প্রকাশনা শিল্পে আধুনিকতার অন্যতম রূপকার, সহায়ক পাঠ্য বইয়ের সাড়া জাগানো পথিকৃৎ আর কেউ নয়। তিনি কামরুল হাসান শায়ক।

‘এলোমেলো দুঃখগুলো’র (১৯৯৮) কবি কামরুল হাসান শায়কের কবি পরিচয় চাপা পড়ে গেছে তার সফল মুদ্রণ বিশেষজ্ঞ ও প্রকাশক পরিচয়ের আড়ালে। বাংলাদেশের প্রকাশনা-শিল্পকে সমষ্টিগতভাবে বিশ্বমানে উন্নীত করে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা প্রবাহে যুক্ত করতে প্রায় তিন দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছেন শায়ক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বইমেলা আয়োজন ও অংশগ্রহণের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় তিনি অন্যতম পুরোধা। জাতীয় পর্যায়ের সব বইমেলা, ফ্রাংকফ্রুট, লন্ডন কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় বাংলাদেশের সরব উপস্থিতিরও পেছনেও আছে তার সক্রিয় অবদান। শায়ক এখন এশিয়া-প্যাসিফিক পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর কো-পাবলিশিং, ট্রান্সলেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন ওয়ার্কিং কমিটির চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি এবং পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.-এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।


কীভাবে প্রকাশনায় এলেন প্রশ্নের জবাবে শায়ক বলছিলেন ‘আমি মূলত লেখালেখি করতাম। বই প্রকাশ করতে এসে প্রকাশনার সঙ্গে জড়িয়ে যাই। আমার বন্ধু এবং পাঞ্জেরীর অন্যতম কর্ণধার আবদুল্লাহ আল বাকীর অনুপ্রেরণায় তার সঙ্গে ব্যবসায় যুক্ত হয়ে পড়ি। প্রকাশনা ব্যবসায় আসার কারণ এই পেশাটায় একটা বিপ্লব ত্বরান্বিত করার নেশা আমাকে পেয়ে বসেছিল। আর আমার নেশা, পেশা স্বপ্নসহ সবকিছুকে একতরফা সমর্থন দিতেন আবদুল্লাহ আল বাকী। সেই সমর্থন তিন দশক পেরিয়ে আজও অব্যাহত আছে।’

শায়কের প্রকাশক হিসেবে ব্যক্তিগত অর্জন অনেক, তবে পাঞ্জেরীর অর্জন কী জানতে চাইলে তিনি বলেন ‘প্রকাশক হিসেবে আমাদের বড় অর্জন আমরা এই সেক্টরে একটা বিশাল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছি। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স ছাড়াও আমাদের আরও তিনটি প্রকাশনা সংস্থা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই প্রকাশের জন্য রয়েছে অক্ষরপত্র প্রকাশনী, বাংলা ভাষাসহ অন্য যে কোনো ভাষার বই ইংরেজিতে প্রকাশের জন্য ওয়ার্ডস অ্যান্ড পেইজেস, ধর্মীয় বই প্রকাশের জন্য দারসুন পাবলিকেশন্স। দেশ-বিদেশের প্রয়োজনীয় সেরা বইয়ের সহজপ্রাপ্তি পাঠকের জন্য নিশ্চিত করতে রয়েছে পিবিএস। এটিই বাংলাদেশের প্রথম বুক স্টোর, ২০০৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া আমাদের রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি। এই ধারণার প্রেসও বাংলাদেশে প্রথম। সেই সঙ্গে পাঞ্জেরীর রয়েছে শক্তিশালী আইটি বেসড স্মার্ট ব্যবসা ব্যবস্থাপনা। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে আমরাই সর্বপ্রথম করপোরেট প্রকাশনা বলে নিজেদের দাবি করি।’ 


পাঞ্জেরীর এবারের বইমেলার প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চাইলে কামরুল হাসান শায়ক জানান ‘প্রতি বছরের মতো এবারও আমাদের প্রস্তুতি বেশ ভালো, তবে এবারের বই প্রকাশের প্রস্তুতি অনেক সমৃদ্ধও। এ বছর সব ধরনের পাঠকের উপযোগিতা বিশ্লেষণ করে আমরা প্রায় ১১৫টির মতো বই প্রকাশ করছি।’

বইয়ের প্রচারণায় পাঞ্জেরী নানা অভিনব পদ্ধতি সবসময় অবলম্বন করে। শায়ক বলছিলেন ‘বইয়ের প্রচারণা নয়, বইয়ের বিপণনের ক্ষেত্রেও পাঞ্জেরী সবসময় এগিয়ে। আমরা মূলত কয়েকটি ধাপে পরিকল্পিতভাবে বইয়ের বিপণনের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি। পাঞ্জেরী যখন একটি বই প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করে, তখন মূলত বইটির সম্ভাব্য পাঠক কারা হতে পারেন, তাদের টার্গেট করে স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং করি। পাঠকের কাছে বইয়ের সহজলভ্যতা ও পি.আর যথাসম্ভব নিশ্চিত করি। পেইড মিডিয়া ক্যাম্পেইনিং, পার্টনারশিপ ক্যাম্পেইন, ইভেন্ট, সাবস্ক্রিপশন, এমপ্ল্যায়ার মার্কেটিং অ্যাকটিভিটি এবং আরও অন্যান্য অ্যাকটিভিটি বছরজুড়ে করে থাকি।’

লেখকদের কাছ থেকে পান্ডুলিপি নিয়ে প্রত্যাশা জানতে চাইলে আধুনিক এই প্রকাশক বলেন, ‘বই প্রকাশে আগ্রহী লেখকদের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা থাকে তিনি সত্যিকার অর্থে প্রকাশ উপযোগী পা-ুলিপি যেন আমাদের দেন। প্রকাশ উপযোগী পান্ডুলিপি বলতে বর্তমান সময়ের পাঠকের জন্য ভীষণ উপকারী, উপযোগিতা সম্পন্ন, বর্তমান সময়ের সীমিত সংখ্যক পাঠকের জন্য উপযোগী হলেও আগামী দিনের পাঠকের জন্য খুবই উপযোগী। এরকম পান্ডুলিপি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করি। মুক্তিযুদ্ধ, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের বিপরীতে কন্টেন্ট আমরা কখনোই প্রকাশ করি না।’

বইমেলা আয়োজনে বাংলা একাডেমির ভূমিকা নিয়ে জানতে চাইলে শায়ক বলেন ‘বাংলা একাডেমির প্রধান কাজ হচ্ছে বাংলা সাহিত্য ও লেখকদের উৎকর্ষ সাধনে সামগ্রিকভাবে গবেষণা, গবেষণালব্ধ উপাদানের বাস্তবসম্মত প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে আমাদের সাহিত্য, লেখক এবং প্রকাশনাকে ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া। এই প্রসঙ্গে আমাদের সর্বজনশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যার একবার তার বক্তব্যে বলেছিলেন ‘বইমেলা আয়োজন করা বাংলা একাডেমির কাজ নয়। এটি প্রকাশকদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সময় এসেছে।’ 

একুশের চেতনা আসলে বইমেলা বহন করে কি না জানতে চাইলে কামরুল হাসান শায়ক বলেন, ‘অমর একুশে বইমেলা তো মূলত ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। ২০১৪ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা সম্প্রসারণের সময় এ বিষয়টি অক্ষুন্ন রেখেই মেলাকে সম্প্রসারণ করা হয়। বইমেলা কমিটির মিটিংয়ে সে সময়ের শ্রদ্ধেয় মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একুশে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভ পর্যন্ত বিস্তৃত করতে চান এই যুক্তিতে যে, ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের যে স্বাধিকার আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়েছিল তার পরিণতি বাঙালি জাতি লাভ করে ৭১-এ স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে। তাই বাংলা একাডেমি চত্বর থেকে মেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভ পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়া উচিত। যুক্তি এতটাই প্রখর ছিল যে সবাই একবাক্যে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, সেবার ভাষাশহীদদের সম্মানে তাদের নামে  বেশ কতগুলো চত্বর নামকরণ করা হয়েছিল। স্বাধীনতাস্তম্ভকে আলোকোজ্জ্বল করা হয়েছিল। এবার এগুলো চোখে পড়েনি। আমাদের মনে রাখতে হবে, বইমেলাকে কেন্দ্র করে যত মহাআয়োজনই আমরা করি না কেন, ভাষা আন্দোলনের চেতনা, স্বাধীনতার চেতনাবোধের জায়গায় আমরা যেন বিন্দুমাত্র বিচ্যুত না হই। এই সবকিছু লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাঙালির অর্জন, বাঙালির অহংকার।’
0 Comments